ওসমান গনি: মানুষ জীবন- জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন রকম পেশায় কর্ম করে বেচে থাকার চেষ্টা করে থাকে। ঠিক সেরকম একটি পেশা হলো কুটির শিল্প।আর সে কুটির শিল্পে কাজ করে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার মানুষ।প্রতি বছরের বর্ষা মৌসুম এলেই শুরু হয় কুটির শিল্পের কাজ। সৃজন শুরু হলেই ফাতেমা বেগমসহ পরিবারের সকল সদস্যের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সন্তানের প্রতিও নজর দেয়ার সময় মেলে না। ঘরে বাহিরে বসে সবাই ব্যস্ত মাছ ধরার চাই, আন্তা,দারকি তৈরিতে। দিনভর আন্তা তৈরি করেন নিবিষ্ট মনে। চৈত্র মাসে দারকির জন্য অগ্রিম এক হাজার টাকা নিয়েছেন হাজেরা।
চুক্তি মোতাবেক এক কুড়ি দারকি বানিয়ে পাইকারকে দিতে হবে। এভাবে ফাতেমা পাইকারের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে দারকি বানাচ্ছেন স্বামীর সংসারে আসার পর থেকেই। সংসার চালাতে উপার্জনের অবলম্বন হিসাবে ফাতেমা বেগমের মতো আমেনা, সোলেমান, সেলিনা, রমজান, আবুল কালাম, আলেয়া, হনুফা ও নাজমা নামে আরও অনেক নারী- পুরুষ দারকি বানান। এভাবেই জীবিকার পথ বেছে নিয়েছেন চান্দিনা উপজেলার কলাগাঁও,লোনা,রসুলপুর,মেহার, লোনা রসুলপুর দারোরাসহ আরো অনেক গ্রামের শত শত পরিবার। বাঁশের শলার তৈরি বিশেষ ধরনের মাছ ধরার ফাঁদের নাম দারকি বা আন্তা। অঞ্চলভেদে দারকির অন্য নামও আছে। কোথাও কোথাও দারকিকে বলে ঘুনি। আবার কোথাও বলে বাইর অথবা দিয়াইব, আন্তা। বর্ষা মৌসুমে নদী-নালা, খাল-বিলে মাছ ধরতে কম পানিতে দারকি পাতা হয়। মাছ ধরার ফাঁদ হিসাবে দারকির ব্যবহার চলে আসছে আবহমান কাল ধরে। গ্রাম বাংলায সর্বত্র দারকি দিয়ে মাছ ধরার প্রচলন এখনও দেখা যায়। খলিশা, টাকি, পুটি, শিং ও কৈসহ নানা প্রজাতির মাছ ধরা হয় দারকি দিয়ে। বাঁশের শলার তৈরি দারকির উভয় দিকে উপরে-নিচে ৩টি করে ৬টি দ্বার (পথ) থাকে মাছ ঢোকার।
দ্বারগুলো এমন ফাঁদবিশিষ্ট যে মাছ একবার ওই দ্বার দিয়ে ঢুকলে আর বের হয়ে আসতে পারে না। দারকির ভেতরকার ঘেরাটোপে মাছ আটকা পড়ে যায়। মাছ ধরার দারকি গ্রামে প্রায় সবার ঘরেই পাওয়া যায়। ব্যাপক হারে চান্দিনার ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পে স্থান করে নিয়েছে। উপজেলার অধিকাংশ গ্রাম বিশেষ এক কুটিরশিল্পে পরিণত হয়েছে। গ্রামের প্রায় পরিবার দারকির ওপর নির্ভরশীল।জীবিকার জন্য সবাই এটাকে প্রধান পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কম বেশী অধিকাংশ পরিবারই এ পেশার সাথে জড়িত। যাদের মাথা গোজার ঘরবাড়ি থাকলেও কারোরই জমি-হালের গরু নেই। অন্য কোন অবলম্বন না থাকায় তারা এ কাজ করে উর্পাজনের অর্থ দিয়ে সংসার চালিয়ে আসছেন।
পুঁজি না থাকায় তারা পাইকারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে এ শিল্প কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আগের দিনে বাঁশের শলা বেত দিয়ে বুনিয়ে দারকি বানানো হতো। এখন বেত তেমন পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও দাম বেশির কারণে বেতের বদলে নাইলনের সুতা বা প্লাষ্টিক ব্যবহার করা হয়। বছরের ৭ মাস দারকি বানান। বাকি পাঁচ মাস দিনমজুরি করেন। কেউ ভ্যানগাড়ি অথবা রিকশা চালিয়ে উপার্জন করেন। মহিলারা বেকার সময় বসে না থেকে দারকির শলা কেটে জমিয়ে রাখেন। চৈত্র মাস থেকে দারকি বানানো শুরু হয় হয়ে কার্তিক- অগ্রহায়ণ পর্যন্ত চলে। চৈত্র মাসের দিকে পাইকার এসে দারকির জন্য আগ্রিম টাকা দিয়ে যায়।প্রতি হাজার টাকার বদলে পাইকাররা নিয়ে যায় এক কুড়ি দারকি। বর্তমানে কাঁচামালের দাম অধিক হওয়ার কারণে অনেকে অর্থাভাবে কুটির শিল্পের কাঁচামাল কিনতে পারেন না যার জন্য অনেকেই তারা বাপ দাদার এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়েছেন। পুতের শিল্পের কারিগরদের বক্তব্য হলো যদি তাদেরকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো তাহলে তারা এ শিল্প টাকে টিকিয়ে রাখতে পারতেন। আগে উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় গেলে প্রায় বাড়িতে দেখা যেত কুঠির শিল্পীরা আপন মনে তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এখন আর সেটা চোখে পড়ে না।