শফিকুল ইসলাম: গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ রাত ১২টা শ্বশুর শফিউল (৫৬) ও জামাই মঞ্জুরুল (৩০) তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেন পুলিশ। এরপর তাদের হাতে হ্যান্ডকাপ ও কোমড়ে রশি দিয়ে বেঁধে গ্রামবাসিদের সামনে পুলিশের পিক-আপে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় থানাতে।
সেখানে তারা জানতে পারেন তাদেরকে ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্র্যাইব্যুনাল-২ এর আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পরোয়ানা মুলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয় কারাগারে।
আদালতে প্রমাণ হয় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতের সিল ও বিচারকের স্বাক্ষরযুক্ত ভূয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা হয় তাদের। এরপর ২২দিন কারাভোগের পর ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রমাণিত হওয়ায় আদালত শ্বশুর জামাইকে মামলা থেকে অব্যহতি দিয়েছেন। সেই সাথে জয়পুরহাট অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এ ঘটনাটি তদন্ত করে জয়পুরহাট জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরির্দশককে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
গত ১৮ জানুয়ারি তাঁরা ঢাকার কেরানীগঞ্জ করাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ভূয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় কারাগারে থাকার ঘটনাটি তদন্ত শুরু করেছে। এঘটনায় কে বা কারা জড়িত তা খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন ভুক্তভোগী ও গ্রামবাসীরা। বিনা অপরাধে কারাভোগ করায় তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শ্বশুর শফিউল ইসলামের বাড়ি জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মহব্বতপুর গ্রামের সাখিদারপাড়ায়। তার জামাই মঞ্জুরুল ইসলামের বাড়িও একই গ্রামে। পেশায় তারা দুজনেই কৃষক।
ভূক্তভোগী শফিউল ইসলাম ও তাঁর জামাই মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, গত ২৮ ডিসেম্বর রাতে তাঁরা খাওয়া শেষে নিজ-নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন। গভীর রাতে ক্ষেতলাল থানার পুলিশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে তাঁদের জামাই-শ্বশুরের বাড়ি ঘেরাও করে রাখেন। হঠাৎ করেই পুলিশ এভাবে অভিযান চালানোয় তাঁরাসহ দুটি পরিবারের লোকজন ভরকে যান। এরপর তাঁরা বাড়ির দরজা খুলে দেন। পুলিশ বাড়ির ভেতরে ঢুকে তাঁদের দুই জনের নাম জিজ্ঞাসা করে। পুলিশকে তাঁরা নিজেদের নাম বলেন। পুলিশ তাঁদের জামাই-শ্বশুরের নামে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত-২ এর সিল ও বিচারের সাক্ষরযুক্ত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখান। এরপর তাঁদের দুই জন জামাই-শ্বশুরকে হাতকড়া পরিয়ে ক্ষেতলাল থানায় নিয়ে যায়। পরদিন ২৯ ডিসেম্বর ক্ষেতলাল থানা পুলিশ তাঁদের দুই জনকে আদালতের হাজির করে। আইনজীবি মাধ্যমে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট আতিকুর ইসলামের আদালতে জামিন আবেদন করেন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাঁদের জয়পুরহাট কারাগারে পাঠিয়ে দেন। জয়পুরহাট কারাগার থেকে গত ৭ জানুয়ারি তাঁদের কেরাণীগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়। কেরাণীগঞ্জ কারাগার থেকে গত ১৮ জানুয়ারি ছাড়া পান। তাঁরা ভূয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় কারাগারে ছিলেন বলে জানতে পারেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত-২ এর পিটিশন মামলা নম্বর ৭২/২০২০ গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় শ্বশুর শফিউল ইসলাম ও জামাই মঞ্জুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই আদালতে ৭২/২০২০ নম্বর পিটিশন মামলার বাদি তাহমিনা রহমান। পিতা আব্দুর রহমান তালুকদার স্থায়ী ঠিকানা হাপানিয়া, উপজেলা গৌরনদী জেলা বরিশাল। এ মামলার এজাহারে তাঁর স্বামী এস,এম আব্দুস সামাদ বকুল, চরপ্রতাপপুর, উপজেলা পাবনা, জেলা পাবনাকে আসামী করা হয়। যৌতুক দাবি করার অভিযোগে তাহমিনা রহমান স্বামীর বিরুদ্ধে ওই মামলা করেছিলেন। ওই মামলার বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শ^শুর শফিউল ও জামাই মঞ্জুরুলের নাম ঠিকানা সম্বলিত আদালতের জাল সিল ও বিচারকের জাল স্বাক্ষরযুক্ত ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ক্ষেতলাল থানায় আসে। সেই পরোয়ানা মূলে গত ২৮ ডিসেম্বর রাতে শ্বশুর শফিউল ও জামাই মঞ্জুরুলকে ক্ষেতলাল থানার পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। শ্বশুরে ও জামাইয়ের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগের কথা শুনে চমকে ওঠে তারা।
পুলিশকে জানায় এ ঘটনায় কোনোভাবেই তারা সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু পুলিশ তাদের কোনো কথা না শুনে রাতে থানায় নেওয়ার পরের দিন ২৯ ডিসেম্বর আদালতে উপস্থাপন করলে আদালতের বিচারক আতিকুর রহমান পরোয়ানা মূলে তাদের জয়পুরহাট জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে জয়পুরহাট হাজত থেকে এ মাসের ৭ তারিখে তাদের ঢাকার কেরানীগঞ্জ জেলহাজতে পাঠানো হয়। জয়পুরহাট চিফ জুুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত থেকে ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বিচারকের কাছে খন্ড নথি পাঠানো হয়। ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের ২ বিচারক ৭২/২০২০ পিটিশন মামলায় মামলার নথি পর্য়ালোচনা করে শফিউল ইসলাম ও মঞ্জুরুল ইসলাম নামে কেউ এ মামলার আসামী নেই এবং তাঁদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জাল ও ভূয়া বলে আদেশের অনুলিপি জয়পুরহাট চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে পাঠান। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ জাহাঙ্গীর আলম ভূয়া গ্রেপ্তারি পরোনায়ায় কারাগারে আটক থাকা শফিউল ইসলাম ও মঞ্জুরুল ইসলামকে অব্যহতি দেন। একই সঙ্গে জাল ও ভূয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুত করার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। শফিউল ইসলাম ও তাঁর জামাই মঞ্জুরুল ইসলাম ভূয়া পরোয়ানায় কারাগারে ছিলেন।
শফিউল ইসলাম বলেন, আমাকে ও আমার জামাইকে ভূয়া গ্রেপ্তারি পরোনায় গ্রেপ্তার হয়ে ২২ দিন কারাগারে রাখা হয়েছিল। আমাদের পায়ে ডান্ডাবরী লাগানো হয়েছিল। আমাদের মতো আর যেন কোন নির্দোষ ব্যক্তি ভূয়া গ্রেপ্তরি পরোয়ানায় কারাভোগ ও হয়রানীর শিকার না হয়। বিনা অপরাধে কারাভোগের জন্য দায়ি ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি করছি। মঞ্জুরুলের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘সামাজিকভাবে আমরা খুব হেয়প্রতিপন্ন হয়েছি। শ্বশুর-জামাই নারী নির্যাতন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে শুনে হতবাক হয়েছি আমরা। যে ভুলে আমাদের মানসম্মান গেল। তার দায় কে নেবে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। মহব্বপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হাকিম বলেন, শফিউল ইসলাম ও তাঁর জামাই কৃষক মানুষ। ঢাকার আদালতে কিভাবে তাঁদের নাম গেল এটা আমরা জানতে চাই। ক্ষেতলাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নীরেন্দ্রনাথ মন্ডল বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানামূলে শফিউল ইসলাম ও মঞ্জুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারি পরোনায়ানা যেভাবে ইস্যু করা হয় তার সবই ছিল। জয়পুরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মোঃ তরিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোনায়ায় দুই জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছিল। পরে ওই দুই ব্যক্তির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ভূয়া বলে নিশ্চিত হয়ে আদালত তাঁদের দুইজনকে মামলা অব্যহতি দিয়েছেন। এঘটনাটি গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ তদন্ত করছে।